Wednesday 24 July 2019

জীবনই মৃত্যু আর মৃত্যুই জীবন - Death after Life and Life after Death (Motivational & Inspirational)

লেখক – প্রদীপ কুমার রায়।
                                        জন্মের পরে মৃত্যু আবার মৃত্যুর পরে জন্ম। এটা একটা স্বাভাবিক নিয়ম। আমরা সবাই মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত  এবং আমাদের সবার মৃত্যু হবে। প্রতিদিন এবং প্রতিনিয়তই আমরা সেইদিকে একটু একটু করে এগোচ্ছি । কেউ দেরীতে , কেউ দ্রুত সেখানে পৌঁছাবে । যে সকল বস্তুর জন্ম আছে , তার পরিণতি অবশ্যই  মৃত্যুতে । সংযোগের পরিণতি বিয়োগে ; যা কিছু রচিত হয় তার পরিণাম স্ব স্ব অংশে ফিরে যাওয়া। জন্মের পরিণাম মৃত্যু এবং মৃত্যু থেকেই জন্মের সুচনা—এ হলো প্রকৃতির নিয়ম। এই মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে যে মানসিকতার দরকার তাই হল চ্যালেঞ্জ অ্রর্থাৎ মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়াবার জন্য আমাদের প্রত্যেকের উচিৎ মানসিকতার পরিবর্তন করা। আর এই চ্যালেঞ্জই মানুষকে শান্তি ও সমদৃষ্টি লাভ করতে সাহায্য করবে । মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়াবার মানসিকতা শান্তির চাবিকাঠি , জীবন সমস্যা সমাধানের পথিক  এবং মৃত্যু খুবই স্বাভাবিক ও অপরিহার্য্য ঘটনা যা মানুষকে বিপদমুক্ত করবে এবং সংসারবন্ধন শিথিল করে দুঃখ , বেদনা ও তৃষ্ণার হাত থেকে মুক্তি দেবে। তাই মৃত্যুই হচ্ছে দৈহিক , মানসিক ও আধ্যাত্মিক ব্যধিসমূহের নিরাময়ের মহৌষধি ।
                                        আমাদের জীবনে দুটি সত্য হলো জন্ম এবং মৃত্যু । দুটি সত্য – জীবন আর জীবনের অভাবই হলো মৃত্যু । দেহ গেলো তো জীবনও গেলো । জীবনের প্রত্যক্ষ প্রমান- আকার , আকৃতি , বৃদ্ধি ও গাতি । জীবনই মৃত্যু আর মৃত্যুই জীবন । একই সঙ্গে পথ আর পথ চলা । কেউ বদলায় না , সাজ ঘরে ফিরে যায়, আর সাজ বদল করে ফিরে আসে। আসলে মৃত্যু বোলে কিছু নেই । প্রকাশ আর অপ্রকাশ , লয় আর বিলয়। অসংখ্য কোষের মতো , অপত্য জীবন। কিছু মরে গেলেই সঙ্গে সঙ্গে নতুন জীবন সেই স্থানটি ভরিয়ে দেবে। একটিই শব্দ “আছে” , “নেই” বলে কিছু নেই। যদি কোনও মানুষ মৃত স্বজন , নষ্ট বস্তু অথবা অতিক্রান্ত বিষয়ের জন্য শোক করে , তবে সে এক দুঃখ থেকে অপর আর এক দুঃখ লাভ করে। এইভাবে সে একটির জায়গায় দুটি অনর্থ প্রাপ্ত হয়। দুঃখেন লভতে দুঃখ – দুঃখের পাওনা আরও দুঃখ । যা হবার হবেই – কেউই জীবিত থাকবে না। আসা – যাওয়ায় মাততেই হবে-এটাই কালের অমোঘ নিয়ম । এই কালই হচ্ছে মহাশক্তিধর , অতিভীষণ লোকক্ষয়ী কাল, সংহারকারী কাল বা মহাকাল। জীবনের দুই অবস্থা ভিন্ন । মৃত্যু একরকম , জীবন আর একরকম ।জন্ম আর মৃত্যু যেখানে এক সেখানেই সৃষ্টিকারীর অবস্থান । সুখ আর দুঃখ আলাদা কিছু নয়। জয় ও পরাজয় দুটিই সমান।
                                      আমাদের জড় দেহটি নশ্বর , বিনাশশীল কিন্তু দেহস্ত আত্মার কখনও বিনাশ বা মৃত্যু হয় না । আত্মাই হচ্ছে জীবের প্রকৃত সত্তা , তাই প্রকৃতপক্ষে কোনও জীবের মৃত্যু নেই। তাই জ্ঞানী ব্যক্তিরা জীবের অস্থায়ী জড় দেহের  বিনাশে কখনও  শোকাচ্ছন্ন হন না । কারন আত্মা নিত্য ও  সনাতন। জড়দেহ সতত পরিবর্তনশীল । আজ যে শিশু , অচিরেই সে যুবক হবে আর তারপরে বৃদ্ধ হবে । কিন্তু দেহ এইভাবে পুরো বদলে গেলেও ব্যক্তিটি বদলায় না , তার কারন প্রকৃত ব্যক্তিটি দেহ নয় , দেহস্ত আত্মা । দেহ বিনষ্ট হোলেও আত্মার মৃত্যু হয় না । মানব জীবন চঞ্চল , প্রত্যেককে নিত্য মরণ চিন্তা অভ্যাস করতে হবে। মানুষ একদেহ ত্যাগ করে আর এক নুতন দেহ লাভ করে। এতে শোকের কিছুই নাই , এতে কাঁদবার  কিছু নাই । শোক করলে কি  মানুষ জীবিত হবে? এই স্থির বুদ্ধি সকলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এবং এটা লাভ করা যায় নিত্য মৃত্যু চিন্তা থেকে।
                               সাধারণতঃ আত্মার কোনও আকৃতি আমরা খুঁজে পাই না , তবে ঋষিগণ তাঁদের সাধনালব্ধ জ্ঞানের দ্বারা জেনেছেন যে আত্মা গোলাকৃতি অ্রর্থাৎ সুগোল । আমরা শ্রাদ্ধ কাজে যে পিণ্ড দান করি সেটা গোলাকৃতি করা হয়। আসলে ঐ পিণ্ডই হলো যার শ্রাদ্ধ কাজ করা হচ্ছে তাঁর আত্মার প্রতীক।শ্রীমদ্ভাগবতের দ্বাদশ স্কন্ধের পঞ্চম অধ্যায়ে পরীক্ষিতের মৃত্যুভীতি নিবারণের চেষ্টার কথা বর্ণনা করা হয়েছে। এখানে বলা হচ্ছে যে “ তুমি মরবে “ এই অবিবেচক বুদ্ধি পরিত্যাগ করতে। তার কারন স্বয়ং জ্যোতিস্বরূপ আত্মার জন্মও নাই আবার বিনাশও নাই । এটা দেহ থেকে ভিন্ন , আকাশের মতো নির্বিকার আধার যেটা স্থুল ও সূক্ষ এবং তাই এটা উপমাশূন্য বিভু । আমাদের দেহ জন্মের আগেও ছিলো না এবং জন্মের পরেও থাকবে না । দেহ জন্ম ও মৃত্যুর মধ্যকালে অল্প সময়ের জন্য আবির্ভূত হয় এবং অল্পকালের জন্যেই প্রকাশ পায়। দেহ যতদিন থাকে , ততদিন একই রুপেও থাকে না, অঙ্গপ্রত্যাঙ্গাদির হ্রাস বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন পরিণতি লাভ করে। কোনো অঙ্গ বিশেষের নাশ হলেও মানুষ বা প্রাণী জীবিত থাকে । তাই হাত , পা অন্যান্য অঙ্গযুক্ত দেহ কখনও আত্মা হতে পারে না। আত্মা দেহের অধীন নয় , দেহের পরিচালক।
                               অতি সম্প্রতি মরগ্যান হিঃম্যানের উপস্থাপনায় মার্কিন বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্যচিত্রের সম্প্রচার মাধ্যম সায়েন্স চ্যানেলে  সম্প্রচারিত দুই মার্কিন পদাথর্বিদের বক্তব্যকে উদ্ধৃত করে কয়েকটি বিজ্ঞানভিত্তিক ওয়েবসাইট “ আত্মা অমর “ – এই বক্তব্যকে সামনে এনেছে। দুই মার্কিন  পদাথর্বিদ  ডক্টর হ্যমারহফ এবং  স্যার রজার পেনরোজের দাবি , আত্মা মস্তিষ্কের মাইক্রোটিবিউলে থাকে।  তাদের মতে মানুষের মস্তিষ্ক যেন একটা কম্পিউটারের হার্ডওয়্যার । যখন কারও মৃত্যু হয় , তখন তার আত্মার মৃত্যু হয় না । সেটি মহাবিশ্বেই ছাড়িয়ে পড়ে । এমনকি শরীরের বাইরে বেরিয়ে যাওয়া তথ্যরূপী আত্মা মস্তিষ্কের মাইক্রোটিবিউলে আবার ফেরত যেতে পারে। এসব দাবি কোনও আধ্যাত্মবাদী ব্যাক্তির নয় , এসব দাবিই ঐ দুই মার্কিন  পদাথর্বিদের । তারা এই প্রক্রিয়াটিকে  অর্কেস্ট্রেটেড অবজ্যাকটিভ রিডাকশান বা অর্ক - এর নামে অভিহিত করেছেন। মানুষ যখন মারা যায় ( ক্লিনিক্যালি ডেথ ) , তখন মস্তিষ্কের মাইক্রোটিবিউলগুলির অবস্থা পরির্বতিত হতে থাকে , যদিও  তাদের তথ্য ধরে রাখার ক্ষমতা তখনও থেকে যায়।  “দ্য সায়েন্স “ চ্যানেলে সম্প্রচারিত তথ্যচিত্র “ থ্রু দ্য ওয়ার্মহোল “ – এ ডক্টর হ্যমারহফ বলছেন , ধরুন হৃৎপিন্ড কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে , রক্ত প্রবাহও থেমে গিয়েছে , তখন মাইক্রোটিবিউলগুলোও  তাদের তথ্য ধরে রাখার সক্ষমতা হারাতে থাকে । কিন্তু মাইক্রোটিবিউলগুলিতে থাকা কোয়াণ্টাম তথ্য একেবারে হারিয়ে যায় না। কারন সেটাকে ধ্বংস করা যায় না , তা মহাবিশ্বেই ছাড়িয়ে পড়ে । তিনি আরও বলেছেন , কোমায় থাকা ব্যক্তি যদি চেতনা ফিরে পান  তখন ওই কোয়াণ্টাম তথ্য আবার কোষের ভিতরে প্রবেশ করতে পারে । ওইরকম সমেয়েই কোমা থেকে ফিরে আসা  ব্যক্তিরা  বলেন যে তারা মৃত্যুকে অনুভব করেছেন। আর যদি  ব্যক্তিটি কোমা থেকে ফিরে না আসেন  , সেক্ষেত্রে তার মস্তিষ্কে থাকা কোয়াণ্টাম তথ্য তার শরীরের বাইরে অনির্দিষ্ট কালের জন্য ছড়িয়ে পরে আত্মা হিসাবে ।
                                     ডক্টর হ্যমারহফের বক্ত্যবের অ্রর্থ , আত্মা নিছক মস্তিষ্কের নিউরনের মিথস্ক্রিয়া নয়, বরং তাদের ইঙ্গিত হচ্ছে , কোয়াণ্টাম তথ্যরূপী আত্মা সময় সৃষ্টির আগে থেকেই বিদ্যমান । ডার্ক ম্যাটার  ও  ডার্ক এর্নাজির মতো বিষয়গুলি আমরা দেখতে পাই না কিন্তু স্বীকার করে নিয়েছি যে সেগুলি  আছে । আত্মার বিষয়ে হ্যমারহফ ও পেনরোজের তত্ত্ব হয়তো সেইরকমই গ্রহণযোগ্য বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে ।

No comments:

Post a Comment