লেখক - প্রদীপ কুমার রায়
"গাজন" গ্রাম বাংলার এক প্রাচীন ও জনপ্রিয় লোক উৎসব ,অর্থাৎ গাজন হলো একটি বিশ্বাস । গাজন একটি হিন্দু উৎসব যেটা সাধারনতঃ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন গ্রামে পালিত হয়। এই উৎসব সাধারনতঃ শিব ঠাকুর ,নীল ঠাকুর বা ধৰ্ম ঠাকুর এর উদ্দেশ্যে পালিত হয়। প্রত্যেক বছর চৈত্র মাসের শেষ দুই সপ্তাহে এই উৎসব পালিত হয়, যেটা কিনা শেষ হয় চরক পূজায় । কোথাও কোথাও আবার এই উৎসব বৈশাখ মাসেও পালিত হয় , যার শেষ হয় বুদ্ধপূর্ণিমায় ।
বিভিন্ন কাহিনী প্রচলিত আছে এই উৎসবের উৎস নিয়ে । এর মধ্যে সর্ব্বাধিক প্রচলিত বোধহয়ই বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের হিন্দু ধৰ্ম গ্রহণ করা নিয়ে। সময়ের সাথে সাথে এটি দেবাদিদেব মহাদেবের প্রতি উৎসর্গকৃত এক উৎসবে প্রিপরিণত হয়েছে। এই প্রসঙ্গে বলা যায় যে গাজন শুধুমাত্র গাজন উৎসবে সীমিত থাকে না। এর মধ্যে থাকে ময়ূরপঙ্খী গান, বোলান গান , যাত্রাপালা , সং সাজা , গল্প ও সংলাপ বলা , মেলা ইত্যাদি।
এই অনুষ্ঠান দিনের ও রাতের উভয় বেলাতেই পালিত হয় , যার মধ্যে থাকে বিভিন্ন বীভৎস উৎসর্গ ও নিজেদের শরীরে আঘাত করা , যেটা দেখলে যে কোনও বীরপুরুষের হৃদয়েও কম্প্ন্ন হাতে বাধ্য।গাজন শব্দটি পাওয়া যায় গর্জন বা "রোর "(roar ) , যা সন্ন্যাসীরা এই উৎসবে মাঝে মাঝেই উচ্চারণ করেন। অবশ্য , অন্যভাবে দেখলে বোঝা যায় গাজন শব্দটির দুটি অংশ আছে। একটি হলো গা অথার্ৎ গ্রাম এবং অন্যটি হলো জন অর্থাৎ জনসাধারণ বা গ্রামের মানুষজন । তাই বলা যায় গাজন হলো একটি গ্রামে পালিত গ্রাম্য উৎসব।
শিবের গাজনে , শিব ঐ দিনে বিবাহ করেন মা হারাকালীকে । আর সন্ন্যাসীরা হলেন বরযাত্রী । ধর্মের গাজনে ধর্ম ঠাকুর বিবাহ করেন মা কামিনী-কামাখ্যাকে , আর সন্ন্যাসীরা হলেন বরযাত্রী। ধর্মের গাজন সাধারনতঃ বাঁকুড়া জেলার বিভিন্ন গ্রামে দেখা যায়।
এই গাজন উৎসবের সম্পূর্ণ ইতিহাস পাওয়া যায় না। তবে এই উৎসবের প্রধান জিনিষটি হলো "সন্তুষ্টি" যেটা কিনা খোঁজা হয় যন্ত্রণা , উৎসর্গ এবং ত্যাগের মাধ্যমে। আমরা সাধারণতঃ দেখে থাকি যে গ্রাম বাংলার দুটি নির্দ্দিষ্ট সময়ে উৎসব পালিত হয়। একটি হলো প্রাক বর্ষা এবং অন্যটি হলো বর্ষার পরে। গাজন উৎসব পালিত হয় প্রাক বর্ষায় । গাজন সাধারণতঃ পালিত হয় নিম্নবর্গীয় জাতিদের মধ্যে। প্রাক বর্ষা উৎসবের উদ্দেশ্য হলো পুনরায় শস্য উৎপাদনের সূচনা যেটা কিনা এই সকল নিম্নবর্গীয় জাতিদের মধ্যে আশার আলো বা বেঁচে থাকার আলো নূতনভাবে জাগৃত করে।
পশ্চিমবঙ্গের , বর্ধমান জেলার বিশেষ কিছু জায়গা গাজন উৎসব পালনের জন্য বিখ্যাত। যাদের মধ্যে দুটি জায়গা হলো কুড়মুন এবং কৃষ্ণদেবপুর । আমি পশ্চিমবঙ্গের , বর্ধমান জেলার নাড়ুগ্রামের নাড়েশ্বরের গাজন বিস্তারিতভাবে প্রতক্ষ্য ও অনুধাবন করেছি । নাড়ুগ্রামের নাড়েশ্বরের এই গাজন অনুষ্ঠানের সময় সন্ন্যাসীরা মাঝে মাঝেই চীৎকার করে বলেন "বলো বলো নাড়েশ্বরের শিবমহাদেব " এবং কেউ কেউ মনে করেন যে এই চীৎকার বা গর্জন থেকেই এই উৎসবের নাম হয়েছে গাজন । এখানে মূল উৎসবটি বিভক্ত হয়েছে ফল বিতরণ , রাত গাজন এবং দিন গাজনের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে । প্রতিবৎসর বুদ্ধ পূর্ণিমায় পালিত হয় দিন গাজনের অনুষ্ঠান ,যা কিনা এই উৎসবের শেষ দিন। এখানে সন্ন্যাসীরা পা উপরে ও মাথা নিচে করে আগুনের মধ্যে দোল খান , শক্ত পাটার উপর পেরেক পুঁতে তাতে শুয়ে মন্দিরতলায় আসেন , যেটার পোষাকি নাম "শালেভর " এবং এছাড়াও সন্ন্যাসীরা মন্দির তলায় আসেন "ঊর্ধ্বসেবার" মাধ্যমে , যেখানে পা উপরদিকে রেখে মাথা ঝুলিয়ে সন্ন্যাসীদের আনা হয় মন্দির প্রাঙ্গনে যার মাধ্যমে শেষ হয় তাদের ব্রত ।
নিচের গাজন উৎসবের ভিডিওটি দেখুন , যা কিনা মূলতঃ নারুগ্রামের নাড়েশ্বরের গাজনের অংশ ।
No comments:
Post a Comment